মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

সালিহীনের আলোচনায় রহমত নাযিল হয়। -হিলইয়াতুল আউলিয়া ৭/২৮৫

সেই ‘সালিহ’ যদি হন খাদেমে কুরআন, খাদেমে হাদীস, খাদেমে ইলম ও খাদেমে তালিবুল ইলম, তাহলে তো রহমতের বারিধারাই বর্ষিত হয়। আমাদের পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. ছিলেন এমনই এক মহান ব্যক্তি।

পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর জীবনী ও তাঁর খেদমতে কুরআন বিষয়ে আমার অনুরোধে প্রিয় তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব কিছু মেহনত করেছেন। আলহামদু লিল্লাহ দেরিতে হলেও লেখাটি প্রস্তুত হয়েছে। আশা করি কিছুটা হলেও এটি ‘দের আয়াদ দুরুস্ত আয়াদ’-এর নমুনা হবে।

আসলেই পাহাড়পুরী হুজুরের জীবনীটা لَقَدْ كَانَ فِیْ قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّاُولِی الْاَلْبَابِ -এর মিসদাক।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নসীহত হাসিল করার তাওফীক দান করুন এবং তাঁর অসীম রহমতের

ভাগিদার বানান- আমীন।-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক]

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার ‘পাহাড়পুর’ গ্রামে। ১৩৬৭ হিজরীর ৪ শাওয়াল মোতাবেক ১৯৪৮ সালের ৯ আগস্ট, সোমবারে সেখানেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পিতা হযরত মাওলানা আখতারুজ্জামান পাহাড়পুরী রাহ. ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের ফাযেল। শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর বিশিষ্ট শাগরেদ ও খাদেম এবং হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর সাক্ষাৎ লাভকারী ব্যক্তি।

তাঁর দাদা মুন্সি আবদুল জলীল ছাহেব রাহ. ছিলেন এলাকার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন, মান্যবর ও প্রভাবশালী দ্বীনদার ব্যক্তিত্ব। আশপাশের অনেক গ্রামের মানুষ তাঁকে চিনত। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠকে সমীহ করত। তাঁর নীতি ও আদর্শকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করত।

পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর নানা হযরত মাওলানা আযীমুদ্দীন ছাহেব রাহ. ছিলেন একজন মুখলিস আল্লাহওয়ালা এবং কুমিল্লার ব্যতিক্রমধর্মী আলিয়া মাদরাসা ‘ধামতী আলিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।

মাওলানা আখতারুজ্জামান ছাহেব রাহ.-এর তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মাঝে হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রাহ. ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ। বাবার কঠিন দারিদ্র্যমাখা সংসারের বড় ছেলে।

তাঁর বাবা দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে পড়াশোনা সমাপ্ত করে দেশে আসার পর ঢাকার বড় কাটরা মাদরাসায় খেদমত শুরু করেন। লালবাগ মাদরাসা তখনো জামিয়ার রূপ লাভ করেনি এবং বড় কাটরা থেকে প্রবীণ আসাতিযায়ে কেরাম এসে লালবাগে যোগদান করেননি। সেসময় হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর কথায় তিনি দিনের বেলা বড় কাটরায় পড়িয়ে রাতে চলে আসতেন লালবাগে। সেখানে তখন কেবল মকতব, হেফযখানা ও কিতাবখানার প্রাথমিক কয়েক জামাত ছিল। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর নির্দেশে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যকরি যিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এরই মধ্যে উজানীর কারী ইবরাহীম ছাহেব রাহ. একদিন ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়পুর গিয়েছিলেন। চলতি পথে এখন যেখানে পাহাড়পুর মাদরাসা ঠিক সেই জায়গায় এসে হঠাৎ ঘোড়া থামিয়ে বলেছিলেন, ‘এখানে আমি ইলমের গন্ধ পাচ্ছি।’

একথা শুনে সে অঞ্চলের বরেণ্য আলেমেদ্বীন হযরত মাওলানা আলতাফ আলী ছাহেব রাহ. সেই এলাকার কৃতিসন্তান মাওলানা আখতারুজ্জামান ছাহেব রাহ.-কে বললেন, ‘পাহাড়পুরে তো এখন খুব দ্রুত মাদরাসার কার্যক্রম শুরু করা দরকার।’

তিনি বললেন, পীরজী হুজুর (বড়কাটরা মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব ছাহেব রাহ.) অনুমতি না দিলে তো আমি বড় কাটরা ছেড়ে আসতে পারি না।

পরে পীরজী হুজুর রাহ.-কে বিষয়টি জানালে তিনি খুব খুশি হন এবং এই বলে অনুমতি দেন যে, ‘শহরের নামকরা মাদরাসায় পড়ানোর চেয়ে এখন গ্রামে দ্বীনের খেদমত করা বেশি প্রয়োজন। তুমি গ্রামে গিয়েই খেদমত করো।’

এরপর থেকে জীবনের শেষ সময় (১৭ জুমাদাল উলা ১৪৩৩ হিজরী মোতাবেক ৯ এপ্রিল ২০১২ ঈসায়ী, রোজ সোমবার) পর্যন্ত তিনি একেবারে জীবন উৎসর্গ করে পাহাড়পুর মাদরাসার খেদমত করেন।

মাদরাসার জন্য সার্বক্ষণিক ধ্যান, মেধা, সম্পদ ও জীবন উৎসর্গকারী এই মনীষীর ঘরেই বেড়ে উঠেছেন হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.।

শিক্ষাজীবন

পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর লেখাপড়ার হাতেখড়ি তাঁর মায়ের কাছে। আলিফ-বা-তা-ছা থেকে কায়েদায়ে বোগদাদী পর্যন্ত মায়ের কাছেই সম্পন্ন করেন। এরপর তাঁর নানা হযরত মাওলানা আযীমুদ্দীন ছাহেব রাহ. তাকে নিজের কাছে রাখেন। সেখানেই (নানার কাছে) মকতব ও নাযেরা সমাপ্ত করেন। এরপর আনুমানিক ১৯৫৫ সালে তার বাবার প্রতিষ্ঠিত ‘পাহাড়পুর এমদাদুল উলূম ইসলামিয়া মাদরাসা’য় কিতাব বিভাগে ভর্তি হন।

সেখানে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত কিতাব বিভাগের প্রথম জামাত থেকে জালালাইন জামাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পাহাড়পুর মাদরাসা তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি গ্রামীণ মাদরাসা। বিভিন্ন প্রয়োজনে সেখানের তালিবুল ইলমরাও তখন উস্তাযদের সঙ্গে বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করত। হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. পরবর্তীদের শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে মাঝে মধ্যে সেসব কাজের কিছু বিবরণ শোনাতেন। মাদরাসার জন্য মাটি কাটা, পাট কাটা, মাটি বহন করা, ঘর তোলা ইত্যাদি কাজে খুব আগ্রহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে শরীক হন তাঁরা। এসব কাজের সূত্রে মাদরাসার প্রতি তাঁদের মহব্বত আরো বেড়ে যায়।

একবারের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘পাহাড়পুর মাদরাসার সামনে এখন যে বিস্তৃত খোলা ময়দান, আগে এই জায়গাতে ছিল বিরাট একটি ডোবা। আব্বা এখানে মাদরাসার আয়ের উদ্দেশ্যে পাট চাষ করতেন। পাটগাছ বড় হলে তালিবুল ইলমদের নিয়েই পাট কাটতেন। আমার মনে পড়ে, সেই কাজে একবার আমিও শরীক হলাম। আমার ডান হাতে ছিল ধারালো কাস্তে। বাম হাতে পাটগাছ। আমি সজোরে কাস্তে চালালাম। কিন্তু তা পাটগাছে না লেগে, লেগে গেল আমার হাতে। এতে হাত অনেকটা কেটে গেল। সেই কাটা দাগ সৌভাগ্যময় স্মৃতিচিহ্নরূপে এখনো আমার হাতে আছে।’

তবে এসব কাজের ভেতর দিয়েই তিনি খুব ভালো পড়াশোনা করেন। আসাতিযায়ে কেরামের নেকদৃষ্টি ও গভীর মহব্বত লাভ করেন। সেখানে যেসকল উস্তাযের কাছে তিনি পড়েছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন-

তাঁর মুহতারাম আব্বাজান হযরত মাওলানা আখতারুজ্জামান পাহাড়পুরী রাহ.

হযরত মাওলানা আলতাফ আলী ছাহেব রাহ.

হযরত মাওলানা আবদুস সুবহান ছাহেব রাহ.

ও হযরত মাওলানা আবদুর রব ছাহেব (মদীনা হুজুর) রাহ. প্রমুখ আত্মত্যাগী উলামায়ে কেরাম।

সেসময় পাহাড়পুর মাদরাসায় কেবল জালালাইন জামাত পর্যন্তই ছিল। হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. জালালাইন সমাপ্ত করে তাঁর বাবার কাছে ঢাকার লালবাগ মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। বাবা শর্ত যুক্ত করে বলেন, ‘লালবাগ মাদরাসায় ভর্তি হতে হলে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-কে মুরব্বি মানতে হবে। অন্যথায় হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হতে হবে।’

তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-কে মুরব্বি মেনে চলার শর্তে লালবাগ মাদরাসায় মেশকাত জামাতে ভর্তি হন। সেটা ছিল ১৯৬৮ সাল।

লালবাগে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর তত্ত্বাবধানে

লালবাগ মাদরাসায় মেশকাত ও দাওরা- এই দুই বছর পড়াশোনা করেন তিনি। এসময় হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-কে মুরব্বি মেনে চলার ওসিলায় অন্য উস্তাযদের মহব্বত লাভ করাও তাঁর জন্য সহজ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘এই দুই বছর প্রতি শুক্রবার জুমার পর হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. লালবাগ শাহী মসজিদে যে খাছ বয়ান পেশ করতেন, সেখানে আমি নিয়মিত হাজির হতাম এবং মিম্বরের ডান পাশে বসতাম। যদি কোনোদিন কোনো কারণে হাজির হতে না পারতাম, শুনতাম- বয়ান চলাকালে নাকি হুজুর বারবার ডান দিকে ফিরেছেন এবং একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করেছেন-

آج وہ بچہ نہیں آیا؟

(ওই ছেলেটি আজ আসেনি?)।’

মেশকাত পড়ার পর দাওরা শুরু হওয়ার আগে যে রমযান মাস, ইচ্ছে ছিল সেই রমযানে তিনি গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় যাবেন। সেখানে সদর ছাহেব হুজুর হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ.-এর কাছে ‘কারীমা’ পড়বেন। সদর ছাহেব হুজুর তখন প্রতি রমযানে সদ্য ফারেগ তালিবুল ইলমদেরকে শেখ সাদী রাহ.-এর ‘কারীমা’ কিতাবটি পড়াতেন। তিনি বলতেন, মাদরাসাগুলোতে যদিও প্রাথমিক শ্রেণির দরসে ‘কারীমা’ পড়ানো হয়, সেটা হয় বিশেষত ফার্সী চর্চার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই কিতাবটির ভাব ও বক্তব্য অত্যন্ত গভীর। যা মাওলানা তালিবুল ইলমদের পক্ষে উপলব্ধি করা সহজ। তাছাড়া কিতাবের বিষয়গুলো তাদের জন্য খুবই উপকারী। তাই এটি আবার পড়ানো দরকার।

এই চিন্তা থেকে তিনি সদ্য ফারেগ তালিবুল ইলমদেরকে খেদমতে যাওয়ার আগে ‘কারীমা’ পড়িয়ে দিতেন। সেজন্যে দূর দূরান্ত থেকে অনেক তালিবুল ইলম রমযান মাসে গওহরডাঙ্গা যেত।

পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. বলেন, ‘সে বছর মাওলানা আমিনী ছাহেবও যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি তখন সদ্য ফারেগ হয়েছেন। আর আমি যদিও মেশকাত পড়েছি, তবে পরবর্তীতে কখনো সুযোগ হয় কি না- এ আশঙ্কায় সেবারই যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ. আমার এই নিয়তের কথা জানতে পেরে বললেন, গওহরডাঙ্গায় যাওয়ার সুযোগ তো সামনে হবে ইনশাআল্লাহ। তবে আগামী বছর আমি প্রায় ১২ বছর পর বুখারী শরীফ পড়াব। তাই রমযানে তুমি লালবাগ থাকলে এবং আমার তত্ত্বাবধানে কিছু কিতাব মুতালাআ করলে ইনশাআল্লাহ বিশেষ ফায়দা হবে। সে অনুযায়ী আমি লালবাগ থেকে গেলাম এবং শাইখুল হাদীস ছাহেব হুজুরের কথামতো কিতাবপত্র মুতালাআ করলাম।’

সেই রমযানে লালবাগ থাকার ফায়দা প্রসঙ্গে বলেন, ‘সেই রমযানে লালবাগ থাকার কারণে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর আরো ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। মাঝে মাঝেই হুজুরের খেদমতে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। এভাবে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর সাথে সম্পর্ক আরো মজবুত হয়েছে। তবে কুরবানী ঈদের পরপর হযরত সদর ছাহেব হুজুর রাহ.-এর ইন্তেকাল হয়ে যাওয়ায় তাঁর সাথে আমার আর দেখা করার সুযোগ হয়নি। যদিও এটা ছিল আল্লাহ তাআলারই ফায়সালা এবং তাঁর কুদরতী বিষয়। তার পরও হযরত শাইখুল হাদীস ছাহেব হুজুর আফসোস করে বলতেন, আহা! রমযানে আমি তোমাকে গওহরডাঙ্গা যেতে দিলাম না!’

অবশ্য হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. ছোটবেলা একবার তাঁর বাবার সাথে ঢাকায় এসে সদর ছাহেব হুজুর রাহ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বাবা তখন তাঁকে হুজুরের কাছে রেখে বাইরে কোথাও কাজে গিয়েছিলেন। এসময় বেশ কয়েক ঘণ্টা তিনি হুজুরের কামরায় হুজুরের কাছেই ছিলেন। সেই ঘটনার স্মৃতিচারণাও করেন তিনি।

বলেন, ‘আমার স্পষ্ট মনে আছে, শৈশবের অবুঝ বয়স হেতু আমি তখন সদর ছাহেব হুজুরের ডেস্কের উপর রাখা কোনো কাগজ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাইলাম। হুজুর বললেন, ‘তুমি এটা না, এটা ধর।’ এই বলে আমার দিকে অন্য একটি কাগজ এগিয়ে দিলেন।

বেশ কয়েকবার এমন হল এবং প্রত্যেকবারই হুজুর অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে অবুঝ একটি বালককে সামাল দিলেন। এরপর আর তাঁকে দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য আমার হয়নি।’

দাওরার পর নূরিয়ায় এক বছর

হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. ১৩৮৯ হিজরী মোতাবেক ১৯৬৯ সালে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করার পর করাচি গিয়ে আরেকবার দাওরা পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে বিষয়ে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর কাছে অনুমতি চাইলে তিনি বলেন-

اجازت نہیں ہے

(অনুমতি নেই)

মুরব্বির এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ইচ্ছা ও পরিকল্পনা মন থেকে দূর করে দেন।

রমযানের পর হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. তাকে কামরাঙ্গীর চরের মাদরাসায়ে নূরিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন। এরপর বছরের শেষের দিকে একদিন দফতরে ডেকে বলেন, আপনি না করাচি যেতে চেয়েছিলেন?

উত্তরে বললেন, আপনার ইজাযত তো পাইনি।

জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি যাওয়ার শওক (আগ্রহ) আছে?

বললেন, যদি হুজুরের ইজাযত হয়।

একথা শুনে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. বললেন-

اجازت ہے

(অনুমতি আছে)

এবার মুরব্বির অনুমতি পেয়ে তিনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন এবং আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই করাচি গিয়ে পৌঁছলেন। এটা ১৯৭০ সালের শেষদিকের কথা। তখন ১৩৯০ হিজরীর শাবান মাস চলছে।

লালবাগে তাঁর কয়েকজন উস্তায

লালবাগে তিনি যেসকল উস্তাযের কাছে পড়েছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন-

আমীরে শরীয়ত হযরত মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রাহ.

হযরত মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ ছাহেব (মুহাদ্দিস ছাহেব হুজুর) রাহ.

হযরত মাওলানা আবদুল মাজীদ ছাহেব ঢাকুবী হুজুর রাহ.

হযরত মাওলানা আবদুল কবীর ছাহেব রাহ.

মুফতী দীন মুহাম্মাদ খান ছাহেব রাহ.

মুফতী আবদুল মুঈয ছাহেব রাহ.

ও শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ. প্রমুখ দেশবিখ্যাত উলামায়ে কেরাম।

পাকিস্তানে এক বছর

১৩৯০ হিজরীর শাবান মাসে তিনি করাচি গিয়ে দেখেন আল্লামা ইউসুফ বানূরী রাহ.-এর বুখারী শরীফের দরস এখনো শেষ হয়নি। বিভিন্ন কারণে নেসাবের বড় একটি অংশ রয়ে গেছে। সেই সুযোগে তিনি জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ায় হযরত বানূরী রাহ.-এর দরসে শরীক হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।

রমযানের পর ‘জামিয়া খাইরুল মাদারিস মুলতান’-এ ভর্তি হন। সেখানে আল্লামা শরীফ কাশ্মিরী রাহ.-এর তত্ত্বাবধানে ‘ফুনূনাত’ বিভাগে পড়াশোনা করেন এবং তাঁর বিশেষ স্নেহ ও সান্নিধ্য লাভ করেন।

সেখানে পড়াশোনাকালে এক ছুটিতে তিনি লাহোরে সফর করেন এবং মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রাহ. ও মাওলানা রাসূল খান ছাহেব রাহ.-সহ আরো কয়েকজন আকাবির উলামায়ে কেরামের যিয়ারত ও সোহবত লাভ করেন।

হাফেজ্জী হুজুরের চিঠি ও দেশে ফেরা : শিক্ষণীয় কিছু বিষয়

সেই শিক্ষাবর্ষের শেষদিকে যখন বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র ২০ দিন বাকি, এমন সময় বাংলাদেশ থেকে একটি পোস্টকার্ডে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর চিঠি পৌঁছে। সেখানে একটি বাক্য ছিল-

میرا خط ملتے ہی فوراً آجائے۔

(আমার চিঠি পাওয়া মাত্রই রওয়ানা হয়ে যাবেন।)

এই চিঠি পেয়ে তিনি তাঁর উস্তায আল্লামা শরীফ কাশ্মিরী রাহ.-কে নিজের বিষয়ে বিস্তারিত জানান এবং চিঠিটি তাঁর সামনে পেশ করেন। চিঠি পড়ে তিনি বলেন-

حضرت حافظجی حضور تمکو اتنی محبت کی نظر سے دیکھتے ہیں، تمہیں دیر نہ کرنی چاہیے۔

(হযরত হাফেজ্জী হুজুর তোমাকে এতটা মহব্বতের দৃষ্টিতে দেখেন! তোমার আর দেরি করা উচিত নয়।)

সেজন্য তিনি হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর সবগুলো পরীক্ষা মৌখিকভাবে নিয়ে নেন। এরপর মায়াভরা কণ্ঠে বলেন, ‘বাইরের দেশ থেকে পড়তে এসেছ। এখন আবার চলে যাচ্ছ। জীবনে আর কখনো দেখা না-ও হতে পারে। তাই এক সপ্তাহ পর যেহেতু আমি করাচি যাব, তখন তুমি আমার সাথেই করাচি পর্যন্ত যেও।’

এই কথা বলে তিনি তাঁর টিকিটের টাকা দিয়ে পাহাড়পুরী হুজুরকে এক সপ্তাহ পরের দুটি ট্রেন-টিকেট করে নিতে বলেন। শুধু তাই নয়। পরবর্তীতে যখন জানতে পারেন, ঢাকায় যাওয়ার জন্য তার কাছে বিমানের কনসেশান টিকেট (বিশেষ ছাড়মূল্যের টিকেট) নেই। তখন তিনি মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর কাছে একটি চিঠি লিখে দেন, যেন মুফতী শফী ছাহেব রাহ. এয়ারলাইন্সে চিঠি লিখে তার জন্য একটি কনসেশান টিকেটের ব্যবস্থা করেন।

এভাবে একজন মুশফিক উস্তায তার প্রতি মহব্বত ও দরদ প্রকাশ করেন। তাছাড়া এই ওসিলায় মুফতীয়ে আযম মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়ে যায়। বাস্তবে এসবই ছিল তার মুরব্বি হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর হুকুম পালনের মর্যাদাপূর্ণ প্রতিদান।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. বলেন, ‘আল্লামা শরীফ কাশ্মিরী রাহ.-এর সুপারিশে মুফতী শফী ছাহেব রাহ. থেকে যখন কনসেশান চিঠি নিয়ে আমি বিমানের টিকেট কাটতে গেলাম, দেখি কোনো সিভিল পেসেঞ্জারের পক্ষে তখন করাচি থেকে ঢাকায় বিমানে যাওয়া বেশ দুরূহ ও অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তখন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস চলছে। সেসময় করাচি থেকে ঢাকার ফ্লাইট ভরে কেবল আর্মির লোকেরাই যাচ্ছে। ফলে ঢাকা-করাচি পেসেঞ্জার আপ-ডাউন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ আমি এর কিছুই জানতাম না।’

তিনি বলেন, ‘সেখানে এয়ারলাইন্স অফিসের একজন লোক আমার হাত থেকে মুফতী শফী ছাহেব রাহ.-এর চিঠিটি নিয়ে পড়ল। এরপর বলল, ছুফী ছাহেব! মুফতী সাহেবের চিঠি নিয়ে এসেছেন কনসেশানের জন্য! তাঁর চিঠি না হলে তো আপনি টিকিটই পেতেন না!’

লোকটির কথা সত্যই ছিল। কারণ তিনি বিমানে ওঠার পর দেখেন, একমাত্র তিনি ছাড়া বাকি সকল পেসেঞ্জারই আর্মির লোক। এরপর থেকে পেসেঞ্জার আসা-যাওয়া পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যায়। তখন স্পষ্ট হয় যে, হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. এতটা তাগিদ দিয়ে রওয়ানা হতে না বললে কিংবা বার্ষিক পরীক্ষার জন্য আরো ২০ দিন অপেক্ষা করলে অথবা হযরত শরীফ কাশ্মিরী রাহ.-এর সঙ্গে করাচি না গেলে এবং মুফতী শফী রাহ. চিঠি লিখে না দিলে তখনকার মতো ঢাকায় আসা প্রায় অসম্ভব ছিল। মোটকথা, প্রতিটি ধাপে নিজের আগ্রহের ওপর মুরব্বির কথাকে প্রাধান্য না দিলে বড় জটিল ও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত।

সেদিন হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. দেশে ফিরে আসায় হাফেজ্জী হুজুর রাহ. খুবই খুশি হন। বাদ মাগরিব হুজুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি অত্যন্ত স্নেহ ও মহব্বতের সঙ্গে বলেন, ‘আপনি আজ আমার সঙ্গে রাতের খানা খাবেন। আমি আপনার জন্য বাজার থেকে ছোট মাছ কিনে এনেছি।’

ওদিকে যুদ্ধাবস্থার কারণে কিছুদিনের জন্য নূরিয়া মাদরাসাও বন্ধ। তাই হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর অনুমতি নিয়ে তিনি বাড়িতে চলে যান।

এর দুই আড়াই মাস পর যুদ্ধ শেষ হলে মাদরাসা খোলা হয়। পুনরায় তিনি মাদরাসায়ে নূরিয়ায় যোগদান করেন। এটা ১৯৭২ সালের শুরুর দিকের কথা। সেই সময় থেকে ১৯৯০ সালের আগস্ট পর্যন্ত (মাঝখানে ১ বছর বাদ দিয়ে) প্রায় ১৮ বছর তিনি নূরিয়ায় শিক্ষকতা করেন। এই দীর্ঘ সময়ের অধিকাংশ বছরই সেখানে নাযিমে তালিমাত বা শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। দুয়েক বছর নায়েবে মুহতামিম হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

হাফেজ্জী হুজুর চাইতেন তিনি যেন তালীম-তারবিয়াতেই ব্যস্ত থাকেন

তাঁর ব্যাপারে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ-এর একান্ত ইচ্ছা ছিল, যেন তালীম-তারবিয়তের মধ্যেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন এবং অন্য কোনো ব্যস্ততায় না জড়ান। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঘটনাটি ১৯৮১ সালের। সে সময় হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। নির্বাচনপূর্ব সর্বশেষ জনসভাটি ছিল জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে। হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. ভাবলেন, আমি তো নির্বাচনের কোনো কাজেই অংশগ্রহণ করলাম না। অন্তত শেষ সভাটিতে শরীক হই। তাছাড়া নির্বাচনী ব্যস্ততার কারণে দীর্ঘদিন ধরে হুজুরের সাথে দেখাও হয় না। এই সুযোগে একটু দেখা করে আসি। এ ধরনের আবেগমাখা চিন্তা থেকে তিনি সেদিন বায়তুল মোকাররমে হাজির হলেন। গিয়ে জানতে পারলেন, এই মুহূর্তে হুজুর তাঁর বড় ছেলে তৎকালীন বায়তুল মোকাররমের মুয়াযযিন কারী আহমদুল্লাহ আশরাফ ছাহেব রাহ.-এর কামরায় বিশ্রাম করছেন। তিনি সেখানে সাক্ষাৎ করতে গেলেন।

হযরত হাফেজ্জী হুজুর তাঁকে দেখামাত্রই কিছুটা ধমকের সুরে বলে উঠলেন, আপনি মাদরাসা রেখে এখানে কেন?

উত্তরে তিনি বললেন, হযরত! এ পর্যন্ত নির্বাচনী কোনো প্রোগ্রামে যাইনি। শুধু শেষ সভাটি একটু দেখার জন্য এসেছি।

হুজুর তৎক্ষণাৎ হুকুম করলেন, দেখা তো হয়ে গেছে। এখন চলে যান।

হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. বলেন, ‘এ কথা শোনার পর আর আমার এক মুহূর্ত বিলম্ব করার হিম্মত হল না। তাই মঞ্চের দিকে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে মাদরাসায় চলে এলাম। সভাস্থল ত্যাগ করতে করতেই দেখলাম, লাখো মানুষের তাকবীর ধ্বনির মধ্যে হুজুরকে মঞ্চে ওঠানো হচ্ছে।’

এর আগের একটি ঘটনা। নূরিয়ায় তখন শরহে বেকায়া পর্যন্ত জামাত ছিল। পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. বলেন, ‘তখন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. আমার জন্য কুতুবখানায় সিটের ব্যবস্থা করতে বললেন এবং আমাকে হাদীসের কিতাবসমূহের উল্লেখযোগ্য শরাহ-শুরুহাত মুতালাআ করার নির্দেশ দিলেন। সেইসঙ্গে নিজের বিশ্রাম ও মুতালাআর জন্য কুতুবখানার ভেতরেই নিচু একটি চৌকির ব্যবস্থা করালেন। যেখানে তিনি প্রায়ই বিশ্রাম করতেন। তাছাড়া আমার দিকে দৃষ্টি রাখার বিষয়টি তো ছিলই। তখন মাঝেমধ্যে এসে দেখতেন, আমি কিতাব মুতালাআ করছি। এতে খুব খুশি হতেন। আর বলতেন-

ہاں مولوی عبد الحی! ایسا ہی ہونا چاہئے؛ بس کتابوں کا کیڑا بن جاؤ‏‏۔

(হাঁ, মৌলভী আবদুল হাই! এমনই হওয়া চাই। একদম কিতাবের পোকা বনে যাও।)

মাদরাসায়ে নূরিয়ায় তখন জামাত ছিল শরহে বেকায়া পর্যন্ত। এরপরও হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. তাঁকে হাদীসের শরাহ-শুরুহাত মুতালাআর মধ্যে লাগিয়ে রেখেছেন। তিনিও সেই নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন।

মোটকথা, হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. মনেপ্রাণে চাইতেন, যেন পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. তালীম-তাদরীসের মধ্যেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। আল্লাহর মেহেরবানীতে তিনি তাঁর মুরব্বির সেই চাওয়াকে শতভাগ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। ফলে পরবর্তী জীবনে তাঁর হাতে অনেক বড় বড় আলেম ও মনীষী ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছেন। গড়ে উঠেছে বড় বড় অনেক প্রতিষ্ঠান। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও তাঁর জীবন থেকে বিশেষভাবে এই গুণটি হাসিল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

হজ্বের সফরে সহীহ বুখারীর দরস

১৩৯৫ হিজরী মোতাবেক ১৯৭৫ সালের কথা। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. দশজনের একটি কাফেলা নিয়ে হজ্বের সফরে যাবেন। তখন হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-কে তিনি এই বলে দাওয়াত দিলেন যে, ‘আপনি যে আমাদের সঙ্গে যাবেন, একটি শর্ত আছে। সেটি হল, এই সফরে বুখারী শরীফ পূর্ণ ৩০ পারা আমার কাছে পড়তে হবে।’

সফর ছিল চার মাসের। রমযান, শাওয়াল, যিলকদ, যিলহজ্ব। সৌভাগ্যময় সেই সফরের স্মৃতিচারণায় হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. বলেন, ‘সেটা ছিল আমার জীবনের প্রথম হজ্ব। চার মাসের এই সফরে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. আমাকে পূর্ণ বুখারী শরীফ পড়ালেন। একজন উস্তায ও একজন ছাত্রের এই দরসের অধিকাংশ সবক হয়েছে হারাম শরীফ ও রওযা শরীফের পাশে। কিছু সবক হয়েছে মসজিদে কুবায়। এভাবে পূর্ণ বুখারী শরীফ সমাপ্ত হয়েছে। সেটা ছিল আমার জন্য পরম সৌভাগ্য ও কৃতজ্ঞতার বিষয়।’

নূরিয়ায় দরসে বুখারীর যিম্মাদারী

পরবর্তীতে ১৯৮২ সনে মাদরাসায়ে নূরিয়ায় দাওরায়ে হাদীসের দরস শুরু হয়। সে বছর বুখারী শরীফের প্রথম খণ্ড পড়ানোর যিম্মাদারী থাকে শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ.-এর কাছে। দ্বিতীয় খণ্ড হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর কাছে। এই ফায়সালায় হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. অত্যন্ত খুশি হন এই ভেবে যে, হুজুরের কাছে আরেকবার বুখারী পড়ার সুযোগ হবে। এদিকে সবক শুরু হওয়ার আগের দিন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. পাহাড়পুরী হুজুরকে ডেকে তাঁর দরসে শরীক হওয়ার নির্দেশ দেন। তবে তার আগে ভালোভাবে মুতালাআ করে নিতে বলেন। তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে হুজুরের হুকুম পালন করেন।

পরের দিন দরস শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময়ে তিনি তালিবুল ইলমদের সাথে গিয়ে বসেন। এ প্রসঙ্গে হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. বলেন, ‘তাঁর দরস থেকে উপকৃত হওয়ার মানসিকতা নিয়েই যে আমি দরসে বসেছি, এটা তিনিও জানতেন। তদুপরি দরস শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে ডেকে তাঁর সাথে বসতে বললেন। তখনো আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। এরপর বললেন, ‘আমি তো অসুস্থতা ও দুর্বলতার কারণে মুতালাআ করে আসতে পারিনি, তাকরীরটা আপনিই করেন।’ হযরতের হুকুম, তবে তাঁরই নির্দেশে আগের দিন মুতালাআ করা হয়েছিল, যদিও সেই মুতালাআ ছিল তাঁর দরসে বসার প্রস্তুতি উপলক্ষ্যে। যাইহোক, আমি তাকরীর করলাম। এরপর থেকে সেই দরসে আমাকেই যেতে হয়েছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, হুজুর আমাকে আমার অজ্ঞাতসারেই হাদীসের খেদমতে নিযুক্ত করে দিয়েছেন। সেদিন এটাও বুঝে এসেছে যে, কেন তিনি আমাকে কয়েক বছর আগ থেকেই তাঁর তত্ত্বাবধানে হাদীসের শরাহ-শুরুহাত মুতালাআ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।’

এরপর থেকে হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ. যতদিন নূরিয়ায় ছিলেন বুখারী শরীফের দরস প্রদান করেছেন। মাঝে দুয়েক বছর একাই সম্পূূর্ণ বুখারী পড়িয়েছেন।

মুরব্বির নির্দেশে লন্ডনে কিছুদিন

১৯৮৫ সালের কথা। লন্ডনের একটি মুসলিম সংগঠন পৃথিবীর অনেক দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, উলামা-মাশায়েখ ও বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করে। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও সংহতি ছিল সেই সেমিনারের প্রতিপাদ্য বিষয়। সেখানে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-কে কয়েকজন সফর সঙ্গীসহ দাওয়াত করা হয়। তাঁদের মাঝে হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-ও ছিলেন। দীর্ঘ এক মাসের এই সফরে তাঁরা রওয়ানা হন ১৯৮৫ সালের ২৫ জুলাই। ফিরে আসেন ২৫ আগস্ট।

কিন্তু ফেরার আগে হঠাৎ দেখা গেল সবার পাসপোর্টে ভিসার মেয়াদ লেখা এক মাস। অথচ হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর পাসপোর্টে ভিসার মেয়াদ ছয় মাস। এই অবস্থা দেখে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর কাছে হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান ছাহেব রাহ. বললেন, ‘দুলাভাইয়ের পাসপোর্টে দেখা যাচ্ছে ভিসার মেয়াদ ছয় মাস।’

হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. বললেন, ‘তাহলে আপনার দুলাভাইকে রেখে যাই’। এরপর সত্যি সত্যিই হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এতে নিশ্চয় কোনো খোদায়ী ইশারা আছে। আপনি থেকে যান।’

পাহাড়পুরী হুজুর থেকে গেলেন। কিন্তু তখনও জানা নেই, কোথায় থাকবেন? কী করবেন? কীভাবে করবেন? ব্যস, মুরব্বি বলেছেন। তিনি রাজি হয়ে গেছেন। এরপর তাঁকে রেখে সবাই দেশে চলে এলেন।

এর প্রায় দেড় মাস পর ‘ইস্ট লন্ডন’ বা লন্ডনের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় দ্বীনী খেদমতের একটি ব্যবস্থা হল। সেখানে তিনি একটি মসজিদের যিম্মাদারী গ্রহণ করলেন। সেইসঙ্গে পাশে মক্তব প্রতিষ্ঠা করলেন। সেখানের লোকজন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর জামাতাকে পেয়ে খুবই খুশি হলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁকে আর কিছুতেই ছাড়বেন না এবং তাঁর পরিবারকেও সেখানে নিয়ে যাবেন। সেজন্য তাঁর ভিসার মেয়াদও বাড়িয়ে আনলেন। এভাবে দশ মাস পার হল।

হাফেজ্জী হুজুরের চিঠি এবং পুনরায় নূরিয়ায় যোগদান

এরইমধ্যে একদিন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর একটি চিঠি পৌঁছল। সেখানে লেখা, ‘এখন আমি আপনার জরুরত অনুভব করছি। চিঠি পাওয়া মাত্রই যতদ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে চলে আসবেন।’

এই চিঠি পেয়ে তিনি সেখানের সব পরিকল্পনা স্থগিত করে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু সেখানকার লোকজন তাঁকে কিছুতেই ছাড়তে রাজি নন। এমনকি তারা তাঁর পাসপোর্টও লুকিয়ে ফেললেন। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর তিনি উমরার উদ্দেশ্যে হারামাইনে সফর করলেন। এরপর সেখান থেকে লন্ডনে না গিয়ে সোজা দেশে ফিরে এলেন। এভাবে আপন শায়েখ ও মুরব্বির নির্দেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।

তিনি দেশে ফিরে আসায় হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. সীমাহীন খুশি হন। কারণ, তিনি তখন যিন্দেগীর কঠিন একটি সময় পার করছিলেন। তখন খেলাফত আন্দোলন দুই ভাগ হয়ে গেছে। শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ. নূরিয়া থেকে রুখসত নিয়ে চলে গেছেন। এই প্রেক্ষাপটে তিনি কঠিন মনোবেদনার সাথে সাথে নূরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তাই হযরত পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-কে পেয়ে যেন বিরাট সান্ত্বনা ও প্রশান্তি লাভ করলেন।

এভাবে আবার শুরু হল পাহাড়পুরী হুজুর রাহ.-এর নূরিয়ার জীবন।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

প্রসঙ্গসমূহ:

মনীষীস্মরণ