আতিয়্যা সা‘দী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا يَبْلُغُ العَبْدُ أَنْ يَكُوْنَ مِنَ المُتَّقِيْنَ حَتَّى يَدَعَ مَا لَا بَأْسَ بِه حَذَرًا لِمَا بِهِ البَأْسُ.
বান্দা প্রকৃত মুত্তাকী হতে পারবে না, যতক্ষণ না সমস্যাযুক্ত বিষয় (তথা হারাম) থেকে বেঁচে থাকার জন্য সমস্যামুক্ত (অপ্রয়োজনীয় বৈধ ও মুবাহ) বিষয়ও পরিত্যাগ করবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪২১৫
হাদীসটির উদ্দেশ্য হল- খাঁটি মুত্তাকী হতে হলে সব ধরনের হারাম ও গোনাহের বিষয় থেকে বাঁচতে হবে। আর গোনাহ ও হারাম থেকে বাঁচতে হলে হারাম নয়, কিন্তু হারামের সন্দেহ হয় কিংবা তা করলে হারামে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে; তেমনি গোনাহ নয়, কিন্তু গোনাহের সন্দেহ হয় কিংবা তা করলে গোনাহে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে- এমন সবকিছুও পরিহার করতে হবে। তাকওয়ার এ স্তরকে হাদীস শরীফে এবং সালাফের পরিভাষায় আলওয়ারা‘ শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
সুতরাং ওয়ারা‘ হল- সন্দেহযুক্ত ও আশঙ্কাপূর্ণ সকল বিষয় বর্জন করা। কোনো আমলের ক্ষেত্রে সন্দেহ হচ্ছে, এটা জায়েয, নাকি নাজায়েয; কোনো লেনদেনের ক্ষেত্রে সন্দেহ হচ্ছে, এটা হালাল, নাকি হারাম; তেমনি কোনো অর্থ-সম্পদের ক্ষেত্রে সন্দেহ হচ্ছে, এটা গ্রহণ করা বৈধ, নাকি অবৈধ- এমন অবস্থায় বিষয়টি থেকে বিরত থাকা। তদ্রুপ, কোনো বিষয় জায়েয বা হালাল হওয়ার মৌলিক ধারণা রয়েছে, দলীল-প্রমাণও রয়েছে, কিন্তু অন্য দলীলের কারণে না-জায়েয বা হারাম হওয়ারও সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে, সতর্কতার সাথে এ ধরনের সন্দেহযুক্ত সবকিছু পরিহার করে চলার নাম ওয়ারা‘।
এক হাদীসে বিষয়টা এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে-
الْإِثْمُ مَا حَاكَ فِي النَّفْسِ وَتَرَدَّدَ فِي الصَّدْرِ.
গোনাহ হল তোমার মনে যা খটকা ও সংশয় সৃষ্টি করে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮০০১
অতএব মনে খটকা পয়দা করে এবং অন্তরে সংশয় সৃষ্টি করে- এমন বিষয় ছেড়ে দেওয়া হল ওয়ারা‘।
ওয়ারা‘-এর সুফল অনেক গভীর ও বিস্তৃত। এর মাধ্যমে দ্বীনের অন্যান্য আমলের হেফাযত হয়। হারাম থেকে বাঁচা সহজ হয়। যারা সন্দেহ ও সংশয়যুক্ত বিষয় বর্জন করে চলবে, হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা তাদের জন্য সহজ হবে। আর যারা সংশয়পূর্ণ ও সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হতে থাকবে, ধীরে ধীরে তারা হারামে জড়িয়ে পড়বে।
নুমান ইবনে বাশীর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِه وَعِرْضِه، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ، كَالرَّاعِي يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى يُوشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ،
নিশ্চয় হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। উভয়ের মধ্যে রয়েছে অনেক সন্দেহযুক্ত বিষয়। অনেক মানুষ তা জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে বেঁচে থাকবে, সে তার দ্বীন ও সম্মানের হেফাযত করবে। পক্ষান্তরে যে সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হবে, সে হারামে জড়িয়ে যাবে। যেমন কোনো রাখাল যদি সরকারি সংরক্ষিত ভূমির আশপাশে (পশু) চরায়, তাহলে সমূহ সম্ভাবনা যে, পশু সংরক্ষিত ভূমির মধ্যে ঢুকে পড়বে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৯; সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২
হাদীসটিতে যে বিষয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এরই নাম ওয়ারা‘। অর্থাৎ তুমি যদি সুস্পষ্ট হারাম ও সুস্পষ্ট গোনাহ পরিহার করতে চাও, তাহলে যেসব বিষয়ে হারামে লিপ্ত হওয়ার বা গোনাহ হওয়ার সন্দেহ হয় সেসবও বর্জন করে চল। তখন তোমার মধ্যে গোনাহ ও হারাম থেকে বাঁচার অভ্যাস হয়ে যাবে। ফলে তুমি সহজেই হারাম ও গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।
পক্ষান্তরে হারামের সন্দেহ হয়, গোনাহের সন্দেহ হয়- যদি তুমি এমন বিষয়ে জড়াতে থাক, তাহলে তোমার মধ্যে গোনাহে লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহস জন্ম নেবে। পরিণতিতে হারামের হাতছানি, গোনাহের আকর্ষণ তোমাকে স্পষ্ট হারাম ও গোনাহে লিপ্ত করে দেবে।
এই হাদীসের অন্য রেওয়ায়েতে কথাটি এভাবে এসেছে-
فَمَنْ تَرَكَ مَا شُبِّهَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ كَانَ لِمَا اسْتَبَانَ أَتْرَكَ، وَمَنِ اجْتَرَأَ عَلَى مَا يَشُكُّ فِيهِ مِنَ الْإِثْمِ أَوْشَكَ أَنْ يُوَاقِعَ مَا اسْتَبَانَ
সুতরাং যে সংশয়পূর্ণ গোনাহ বর্জন করবে সে স্পষ্ট গোনাহ বর্জনে আরো যত্নবান হবে। আর যে সংশয়পূর্ণ গোনাহে লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহস দেখাবে, সে অচিরেই স্পষ্ট গোনাহে জড়িয়ে পড়বে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৪৬
ওয়ারা‘ গুণের মাধ্যমে যেহেতু গোনাহ বর্জন করা যায় এবং হারাম থেকে বাঁচা সহজ হয়ে যায়, তাই হাদীস শরীফে ওয়ারা‘কে শ্রেষ্ঠ দ্বীনদারী আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
فَضْلُ الْعِلْمِ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ فَضْلِ الْعِبَادَةِ، وَخَيْرُ دِينِكُمُ الْوَرَعُ.
ইবাদতের ফযীলতের চেয়ে ইলমের ফযীলত আমার নিকট বেশি প্রিয়। আর সর্বোত্তম দ্বীনদারী হল ওয়ারা‘ তথা সন্দেহপূর্ণ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩১৪
বলার অপেক্ষা রাখে না, যার মধ্যে ওয়ারা‘ আছে, যে হারাম ও হারামের মিশ্রণ এবং গোনাহ ও গোনাহের সন্দেহ থেকে দূরে থাকবে, সেই তো বড় মুত্তাকী, সবচে বড় ইবাদতগুযার।
তাই এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
يَا أَبَا هُرَيْرَةَ! كُنْ وَرِعًا، تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ.
হে আবু হুরায়রা! ওয়ারা‘-ওয়ালা হয়ে যাও, তাহলে তুমি সবচে বড় ইবাদতগুযার হয়ে যাবে। Ñসুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪২১৭; আলওয়ারা‘, ইবনে আবিদ্ দুন্ইয়া, হাদীস ০৩; মুসনাদুশ্ শামিয়্যীন, তবারানী, হাদীস ৩৮৫
হাদীসটির অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে-
اتَّقِ الْمَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ.
তুমি হারাম থেকে বেঁচে থাক, তাহলে শ্রেষ্ঠ ইবাদতগুযার হয়ে যাবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮০৯৫
হাদীস শরীফে যেমন ওয়ারা‘-এর গুরুত্ব ও ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে, তেমনি সালাফে সালেহীন তথা মহান পূর্বসূরিদের বক্তব্যেও এর গুরুত্ব ও ফযীলতের কথা এসেছে।
একদিন হাসান বসরী রাহ. মক্কায় প্রবেশ করে দেখেন, এক যুবক কা‘বা শরীফে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষকে নসীহত করছেন। হাসান বসরী রাহ. তার কাছে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন-
مَا ملاك الدين؟
দ্বীনের (সবকিছুর) নিয়ন্ত্রণকারী কী?
যুবক উত্তর দিয়েছেন- الْوَرَع (ওয়ারা‘)
জিজ্ঞেস করলেন-
فَمَا آفة الدين؟
দ্বীন (সবকিছুর) বরবাদকারী বিষয় কী?
জবাব দিয়েছেন- الطَّمْعُ (লোভ)
হাসান বসরী রাহ. এই কথা শুনে অভিভূত হয়েছেন। -আররিসালাতুল কুশাইরিয়্যা, পৃ. ১১২; মাদারিজুস সালিহীন ২/২৩৮
আবুদ দারদা রা. বলেন-
تَمَامُ التَّقْوূى أَنْ يَتَّقِيَ اللهَ الْعَبْدُ حَتَّى يَتَّقِيَه فِي مِثْقَالِ ذَرَّةٍ، حَتَّى يَتْرُكَ بَعْضَ مَا يَرَى أَنَّه حَلَالٌ، خَشْيَةَ أَنْ يَكُونَ حَرَامًا، يَكُونُ حِجَابًا بَيْنَه وَبَيْنَ الْحَرَامِ.
তাকওয়ার পূর্ণতা হল, বান্দা আল্লাহকে ভয় করবে, এমনকি অণু পরিমাণ জিনিসের ক্ষেত্রেও; বরং কিছু হালালও বর্জন করবে- তা হারাম হওয়ার আশঙ্কায়। এই বর্জন তার মাঝে আর হারামের মাঝে প্রতিবন্ধক হবে- তাকে হারাম থেকে রক্ষা করবে। -আয্যুহদ ওর্য়ারাকাইক, ইবনুল মোবারক, পরিশিষ্ট, পৃ. ১৯; আলওয়ারা‘, আহমাদ, রেওয়ায়েত মারওয়াযী, পৃ. ৫৭ (১৭১); জামিউল উলূম ওয়ালহিকাম, ইবনে রজব ১/৪০০
মুআবিয়া ইবনে র্কুরা বলেন, আমি হাসান বসরী রাহ.-এর নিকট প্রবেশ করলাম। তিনি খাটে হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম-
يَا أَبَا سَعِيدٍ! أَيُّ الْأَعْمَالِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ؟
হে আবু সাঈদ! আল্লাহর নিকট কোন্ আমল সবচে প্রিয়?
তিনি উত্তরে বললেন-
الصَّلَاةُ فِي جَوْفِ اللَّيْلِ، وَالنَّاسُ نِيَامٌ.
শেষ রাতে নামায পড়া, মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে।
জিজ্ঞেস করলাম- কোন্ রোযা সবচে উত্তম?
বললেন- গ্রীষ্মকালে রোযা রাখা।
প্রশ্ন করলাম- কোন্ গোলাম আযাদ করা সবচে উত্তম?
বললেন- যে গোলাম মালিকের নিটক অধিক প্রিয় এবং যার মূল্য সব থেকে বেশি।
পরিশেষে প্রশ্ন করলাম-
فَمَا تَقُولُ فِي الْوَرَعِ؟
ওয়ারা‘ সম্পর্কে আপনি কী বলেন?
তিনি জবাব দিয়েছেন-
ذَاكَ رَأْسُ الْأَمْرِ كُلِّه.
ওয়ারা হল সবকিছুর শীর্ষে।
-আলওয়ারা‘, ইবনে আবিদ্ দুনইয়া, পৃ. ৪৮
সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাহ. বলেছেন-
لَا يُصِيبُ الْعَبْدُ حَقِيقَةَ الْإِيْمَانِ حَتَّى يَجْعَلَ بَيْنَه وَبَيْنَ الْحَرَامِ حَاجِزًا مِنَ الْحَلالِ وَحَتَّى يَدَعَ الْإِثْمَ وَمَا تَشَابَهَ مِنْهُ.
কোনো ব্যক্তি ঈমানের হাকীকত অর্জন করতে পারবে না, যাবৎ না সে তার মাঝে ও হারামের মাঝে হালালের প্রাচীর রাখবে এবং গোনাহ ও গোনাহের সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়ও বর্জন করবে। -আলওয়ারা‘, আহমাদ, পৃ. ৫৯
হাসান বসরী রাহ. বলেন-
مَا زَالَت التَّقْوূى بالمتقين حَتَّى تركُوا كثيرا من الْحَلَال مَخَافَة الْحَرَام.
মুত্তাকীগণ তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হতে থাকেন; একপর্যায়ে তারা হারামের ভয়ে অনেক হালালও বর্জন করেন। -জামিউল উলূম ওয়ালহিকাম, ইবনে রজব ১/৪০১; আদর্দুরুল মানসুর, সুয়ূতী ১/৬১
মূসা ইবনে আইয়ান আলজাযারী রাহ. বলেন-
المتقون تنزَّهوا عن أشياء من الحلال مخافة أن يقعوا في الحرام، فسماهم الله متقين.
মুত্তাকীগণ হারামে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় অনেক হালাল থেকেও বেঁচে থাকেন। তাই আল্লাহ তাদের নাম রেখেছেন মুত্তাকী (পরহেযগার)।-জামিউল উলূম ওয়ালহিকাম, ইবনে রজব ১/৪০১
সুফিয়ান সাওরী রাহ. বলেন-
إنما سُمُّوا متقينَ، لأنهم اتقوا ما لا يُتقى.
মুত্তাকীদের মুত্তাকী (পরহেযগার) এজন্যই বলা হয় যে, তারা এমন জিনিস থেকেও বেঁচে থাকেন, যা থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক নয়। -জামিউল উলূম ওয়ালহিকাম, ইবনে রজব ১/৪০১
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ওয়ারা‘ গুণ দান করুন এবং স্পষ্ট ও সন্দেহযুক্ত সব ধরনের গোনাহ ও হারাম থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন।
প্রসঙ্গসমূহ:
দ্বীনিয়াত