জীবনের অনিবার্য বাস্তব একটি পর্বের নাম বিদায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে এই বাস্তবতার সম্মুখীন আমাদের হতে হয়। চাই দীর্ঘদিন বা কিছুদিনের জন্য বিদায়। হোক দীর্ঘ সাহচর্যের পরের বিদায় অথবা অল্প সময়ের সাক্ষাৎশেষে বিদায়। তখন কিছু না কিছু কষ্ট ও অনুভূতি সবাইকে কাতর করে। হৃদয়ের এ অনুভূতিগুলোও আমরা বিভিন্ন শব্দে-বাক্যে প্রকাশ করে থাকি। কিন্তু কাউকে বিদায় দেওয়ার সময় বা কারো থেকে বিদায় নিয়ে ফেরার সময় কী করতে হয়, বা কী বলতে হয় এবং কী করলে বা বললে বিদায়দাতা ও বিদায়গ্রহীতা দুজনেরই কল্যাণ হয়— সে শিক্ষাও ইসলামে রয়েছে। একজন মুসলিম অপর মুসলিম ভাইকে কীভাবে বিদায় দেবে, বিদায়ের সময় কী বলবে— অন্য সকল বিষয়ের মতো এখানেও রয়েছে ইসলামের স্বাতন্ত্র। ইসলামের শেখানো আচরণ ও সম্ভাষণ এবং ইসলামের সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যগুলোও সত্যিই তুলনাহীন। ইহকাল ও পরকালের সকল ক্ষেত্রেই উপকারী ও অর্থবহ। বিদায়ী সম্ভাষণের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যেসব দুআ শিখিয়েছেন সেখান থেকে দুটি দুআ উল্লেখ করা যায়।
প্রথম দুআটি হল—
أَسْتَوْدِعُ اللهَ دِينَكَ، وَأَمَانَتَكَ، وَخَوَاتِيمَ عَمَلِكَ.
আমি তোমার দ্বীন, তোমার আমানত এবং তোমার শেষের আমল ও জীবনের শেষ পরিণতিকে আল্লাহ তাআলার সোপর্দ করলাম। —মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৯৫৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৪৩
অর্থাৎ, তোমার দ্বীন, তোমার আমানত এবং শেষ পরিণাম বা কাজের ফলাফল যেন আল্লাহ তাআলা সুরক্ষিত রাখেন। তোমার দ্বীনদারী তোমার আমানত এবং সকল কর্মের ফলাফল ভালো থাকার লক্ষ্যে সেসব আল্লাহর হাওয়ালা করছি। তাঁর কাছে ন্যস্ত করছি এবং তাঁর সুরক্ষা কামনা করছি।
আরেকটি দুআ—
أَسْتَوْدِعُكَ الله الَّذِيْ لاَ تَضِيْعُ وَدَائِعُهٗ.
আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে গচ্ছিত রাখছি। যাঁর কাছে গচ্ছিত রাখা বস্তু খোয়া যায় না।
অর্থাৎ তোমাকে এমন এক মহা সত্তার যিম্মায় তুলে দিলাম, আমানত ও গচ্ছিত জিনিস যার কাছে কখনো বিনষ্ট হতে পারে না। —মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯২৩০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৮২৫
দুআর মর্ম ও তাৎপর্য
মূলত কারো কাছে কোন কিছু গচ্ছিত রাখার অর্থ ওই বস্তু সংরক্ষণের বিষয়ে তার ওপর নির্ভর করা এবং বিষয়টি তার কাছে সমর্পণ করা। আল্লাহর প্রতি এই ভরসা ও সমর্পণ মুমিনের অনেক বড় গুণ এবং ঈমানী বৈশিষ্ট্য।
প্রখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাকারী আল্লামা মোল্লা আলী কারী রাহ. এর ভাব সম্প্রসারণ করেছেন এভাবে—
(أَسْتَوْدِعُ اللهَ دِينَكَ) أَيْ: أَسْتَحْفِظُ وَأَطْلُبُ مِنْهُ حِفْظَ دِينِكَ، وَالدِّينُ شَامِلٌ لِلْإيمَانِ وَالِاسْتِسْلَامِ وَتَوَابِعِهِمَا، فَإِلْقَاؤُه عَلَى حَالِه أَوْلَى مِنْ تَفْسِيرِه بِالْإيمَانِ لِأَنَّ السَّفَرَ لِمَشَقَّتِه وَخَوْفِه قَدْ يَصِيرُ سَبَبًا لِإِهْمَالِ بَعْضِ أُمُورِ الدِّينِ.
আমি আল্লাহর নিকট তোমার দ্বীনের হেফাজত চাই। তোমার দ্বীনদারীর সংরক্ষণ কামনা করি। ঈমান আনয়ন থেকে শরীয়ত গ্রহণ ও পরিপালনসহ যাবতীয় সব কিছুই ‘দ্বীন’ শব্দের আওতাভুক্ত।
তিনি আরো বলেন, সফরের সময় এই দুআর বড় তাৎপর্য রয়েছে। কারণ সফরের কষ্ট বা বিভিন্ন ঝক্কি-ঝামেলার কারণে অনেক সময় দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো দুআটি খুবই প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী আমল।
(وَأَمَانَتَكَ) أَيْ: حِفْظَ أَمَانَتِكَ فِيمَا تُزَاوِلُهُ مِنَ الْأَخْذِ وَالْإِعْطَاءِ وَمُعَاشَرَةِ النَّاسِ فِي السَّفَرِ إِذْ قَدْ يَقَعُ مِنْهُ هُنَاكَ خِيَانَةٌ، وَقِيلَ: أُرِيدَ بِالْأَمَانَةِ الْأَهْلُ وَالْأَوْلَادُ الَّذِينَ خَلَفَهُمْ، وَقِيلَ: الْمُرَادُ بِالْأَمَانَةِ التَّكَالِيفُ كُلُّهَا...
মুমিনের লেনদেন ও আচার-আচরণ সবকিছুতেই আমানত রক্ষা করা জরুরি। সফরাবস্থায় সেটি আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ এই সময় খেয়ানত ঘটে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে।
আমানত দ্বারা বাসা-বাড়িতে রেখে আসা পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততিও উদ্দেশ্য হতে পারে। কারণ তারা আমার জন্য আমানত। এখানে তাদের জন্যও আল্লাহর হাওয়ালা ও তাঁর সুরক্ষা কামনা করা হচ্ছে। সর্বোপরি কুরআন কারীমে তো পুরো শরীয়তে ইসলামীকেই ‘আমানত’ অভিধায় অভিহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে—
اِنَّا عَرَضْنَا الْاَمَانَةَ عَلَی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ الْجِبَالِ فَاَبَیْنَ اَنْ یَّحْمِلْنَهَا وَ اَشْفَقْنَ مِنْهَا وَ حَمَلَهَا الْاِنْسَانُ اِنَّهٗ كَانَ ظَلُوْمًا جَهُوْلًا.
আমি আমানত পেশ করেছিলাম আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বতের সামনে। তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শঙ্কিত হল। আর তা বহন করে নিল মানুষ। মূলত সে ঘোর জালেম, ঘোর অজ্ঞ। —সূরা আহযাব (৩৩) : ৭২
তাই এই এক দুআর মাধ্যমে মুমিনের পুরো দ্বীন-ঈমান ও সংশ্লিষ্ট সবকিছুর দুআও হয়ে যায়। (দ্র. মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৬৯০, হাদীস ২৪৩৫-৩৬)
ইমাম খাত্তাবী রাহ. বলেন, ‘আমানত’ দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্ততিসহ যাদের ঘরে রেখে সফরে যাওয়া হয়। আর ওসব সম্পদও, যা মানুষ গচ্ছিত রাখে এবং নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির নিকট হেফাজতের জন্য রাখে। এককথায় পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ সংশ্লিষ্ট যতকিছু রয়েছে, সবই এই ‘আমানত’-এর শামিল।
আর ‘দ্বীন গচ্ছিত রাখা’-এর কথা বলার কারণ হল, সফরে থাকে নানান ঝুট-ঝামেলা ও আপদ-বিপদের আশঙ্কা। থাকে অনেক কষ্ট-ক্লান্তির উপাদান। ফলে যে কোনো কারণেই দ্বীন পরিপালনে ঘাটতি আসতে পারে। শরীয়তের কোনো বিধান ছুটে যেতে পারে। সবকিছু যথাযথ থাকার জন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট দুআ করাও শিখিয়েছেন। —মাআলিমুস সুনান ২/২৫৮
দুআর শেষ অংশের মর্ম ও অর্থের বিস্তৃতি হৃদয় ছুয়ে যায়—
কোনো বর্ণনায় রয়েছে—
وَخَوَاتِيمَ عَمَلِكَ.
অর্থাৎ, সফর শেষে আমরা তো পুনরায় পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসি। এই ফিরে আসা যেন দ্বীন-ঈমান এবং জাগতিক, সবদিক থেকে নিরাপদে ফিরে আসা হয়। শুধু তাই নয়, আমার জীবনের শেষ আমল ও পরিণতিও যেন ঈমান ও আমলের ওপর হয়।
মোল্লা আলী কারী রাহ. আল্লামা তীবী রাহ. থেকেও কাছাকাছি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। (দ্র. মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৬৯০, হাদীস ২৪৩৫-৩৬)
বিদায়দাতা ও বিদায়গ্রহীতা দুজনেই উভয় দুআ পাঠ করতে পারি
এই প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দা. বা.-এর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করা যায়। তিনি বলেন,
‘যদিও ‘হিসনুল মুসলিম’ কিতাবে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। মুকীমের জন্য মুসাফিরের দুআ, মুসাফিরের জন্য মুকীমের দুআ।
অর্থাৎ যিনি বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন, তিনি বলবেন—
أَسْتَوْدِعُكَ اللهَ الَّذِيْ لاَ تَضِيْعُ وَدَائِعُه.
আমি তোমাকে আল্লাহর সোপর্দ করলাম, যাঁর কাছে গচ্ছিত রাখা আমানত কখনো নষ্ট হয় না।
আর যিনি বিদায় দিচ্ছেন, তিনি মুসাফিরকে বলবেন—
أَسْتَوْدِعُ اللهَ دِينَكَ، وَأَمَانَتَكَ، وَخَوَاتِيْمَ عَمَلِكَ.
কিন্তু উভয় দুআই এমন যে, বিদায়দাতা ও বিদায়গ্রহীতা দুজনই বলতে পারি। কারণ সকল রেওয়ায়েত সামনে রাখলে বোঝা যায়, উভয় দিক থেকেই উভয় দুআ পাঠ করা যায়। যিনি বিদায় দিচ্ছেন, যিনি বিদায় নিচ্ছেন, দুজনই উভয় দুআ পাঠ করতে পারি। দুটো দুআই খুব তাৎপর্যপূর্ণ। অন্তরকে জাগ্রত রেখে দুআগুলো পড়লে অনেক ফায়েদা। সওয়াব তো আছেই। সাথে ফায়দাও অনেক।’
এই এক দুআতে তিনটি বিষয়কে আল্লাহর সোপর্দ করা হল। কাজেই এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ দুআ।
তিনি আরো বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, বের হওয়ার সময় কাছে কেউ থাকে না। তখন কীভাবে এ দুআগুলো পড়ব? আমি তখন ফোন করে কারো থেকে এ দুআ উসূল করি, অথবা নিজে বলি।
কেউ যদি তার দ্বীন, তার আমানত এবং তার আমলের খাতেমা ও শেষ পরিণতিকে আল্লাহর হাওয়ালা করে, সেটি কি কখনো বিফলে যাবে? কারণ আল্লাহর গুণ হল—
لاَ تَضِيْعُ وَدَائِعُهٗ.
‘তাঁর কাছে রাখা আমানত কখনো নষ্ট হয় না।’ (বয়ান : ৩০ রমযান ১৪৩৭ হিজরী, স্থান : মারকাযুদ দাওয়াহ জামে মসজিদ)
কাজেই সফরের সময় কারো থেকে এমন দুআ পাওয়া নিজের জন্য অনেক বড় পাথেয় ও প্রাপ্তি। কারণ এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমার সবকিছু আল্লাহর হাওয়ালায় দিয়ে দেওয়া হল।
এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দা.বা.-এর একটি লেখার কথাও মনে পড়ে গেল। এক হজের সফরে তাঁকে পাহাড়পুরী রাহ. বলেছিলেন— ‘আপনাকে আল্লাহর হাওয়ালা করলাম, আপনাকে আল্লাহর হিফাযতে দিলাম।’
সে প্রসঙ্গে মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দা. বা. লেখেন, ‘এইটুকু বলার জন্যই তো প্রত্যেক মানুষের জীবনে প্রয়োজন একজন মানুষের, জীবন্ত হৃদয় ও যিন্দাদিল একজন মানুষের। এ প্রয়োজন অতীতে ছিলো, এখনো আছে, সামনেও থাকবে। এরপর তুমি বিশ্বাস করতে পারো যে, পুরো সফরে তুমি নিশ্চিন্ত নিরাপদ ছোট-বড় সবকিছু থেকে, এমনকি শয়তানের হামলা ও নফসের ধোঁকা থেকেও। কারণ আল্লাহর হাওয়ালা ও হিফাযতে থাকা কোনো কিছু কি নষ্ট হতে পারে কখনো! অথচ আশ্চর্য, সফরের জন্য আমরা কত নিরাপত্তার আয়োজন করি, এই একটি ছাড়া! আমরা বুঝতে পারি না, এই নিরাপত্তা ছাড়া অন্য সব নিরাপত্তা অর্থহীন। বিমানের উড্ডয়নলগ্নে জরুরি নিরাপত্তার ব্যবস্থাগুলো যখন খুব গুরুত্বের সাথে বুঝিয়ে দেয়া হয় তখনও আমার মনে হয়, আমরা আকাশের উচ্চতায় উড্ডয়ন করছি ভূমির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে, ‘আকাশ’ থেকে নিরাপত্তা গ্রহণ করার কথা একবারও মনে আসে না!
তুমি যখন নূরানি কলব ও নূরানি যবান থেকে উচ্চারিত—
أَسْتَوْدِعُ اللهَ دِينَكَ، وَأَمَانَتَكَ، وَخَوَاتِيمَ عَمَلِكَ.
-এর নিরাপত্তাবেষ্টনী গ্রহণ করবে তখন তুমি সমস্ত বিপদ-মুছীবত থেকে নিরাপদ হয়ে গেলে, যদি তুমি নিজে এই নিরাপত্তাবেষ্টনী থেকে বের হয়ে না আসো। —বাইতুল্লাহর ছায়ায়, পৃ. ১৭৩
কাজেই ইসলামের শেখানো দুআ ও সংস্কৃতির চর্চা করি। দুআকে জীবনের সর্বোত্তম পাথেয়রূপে গ্রহণ করি। কারণ দুআ ঈমানী যিন্দেগীর বড় সম্বল। আর এমন দুআ যদি সফরের সম্বল না হয়, তাহলে পুরো সফর বড় অস্থিরতার মধ্যে কাটাতে হয়। কাজেই সফরকালে দুআগুলো বিদায়প্রার্থী ও বিদায় দানকারী উভয় দিক থেকেই পড়া যেতে পারে! এটিই হতে পারে আমাদের সফরের বড় সম্বল ও পাথেয়! আল্লাহ তাওফীক দেওয়ার মালিক।
প্রসঙ্গসমূহ:
আদব-শিষ্টাচার