সময় ও পরিস্থিতির পালাবদল আল্লাহ তাআলার একটি শাশ্বত নীতি। ইতিহাসের শুরু থেকেই এই ধারার উজ্জ্বল উপস্থিতি পাওয়া যায়। বর্তমান ও ভবিষ্যতেও এর নজীর ফুটে উঠবে। অনেক সময় এমন হয় যে, জুলুম ও উৎপীড়নের দমবন্ধ অন্ধকার চারদিক ঘিরে ধরে এবং হতাশাগ্রস্ত অন্তরে মনে হতে থাকে এ পরিস্থিতি হয়তো ঘুচবে না। এ অন্ধকার হয়তো আর কাটবে না। কিন্তু গণনাযোগ্য সকল ধারণা ও ফ্রেমের বাইরে থেকেও আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য আলোকোজ্জ্বল উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন।
দুঃশাসন, জুলুম ও দ্বীন-বিদ্বেষীদের আনুকূল্যের এক অমানিশাকে আল্লাহ তাআলা এভাবেই দূর করেছেন এদেশের তারুণ্যকে দিয়ে। কোনো পূর্ব প্রশিক্ষিত রাজনীতি কিংবা পোশাকী শক্তির পরিবর্তে নবাগত তরুণ শিক্ষার্থী, উদ্বেলিত আনকোরা নতুন প্রজন্মকে দিয়ে। এ ছিল এক অভিনব ঘটনা ও খোদায়ী কারিশমা। জুলাই-২৪-এর মধ্যভাগ থেকে নিয়ে আগস্টের প্রথম পাঁচ দিন বাংলাদেশকে আল্লাহ তাআলা তারুণ্যের একটি অপরিমেয় শক্তি, অজেয় সাহস ও প্রত্যয়ের মুখ দেখালেন। বাচ্চাদের ত্যাগ ও সাহসের ডানা কত দূর দিগন্তে উড়ে যেতে পারে, কত বড় জুলুমের বৃক্ষ উপড়ে ফেলতে পারে- নমুনা সামনে হাজির করলেন। পালাবদলের ইতিহাসে এজাতীয় নজীর মানুষের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে দেশ-জাতির বিবিধ পরিস্থিতি এবং নতুন প্রজন্মের নানামাত্রিক সংকট নিয়ে ব্যাপকহারে উদ্বেগ ও হতাশার চর্চাই চালু ছিল।
মনে করা হাচ্ছিল, উপস্থিত এই তারুণ্যের সঙ্গে ত্যাগ ও সাহসের কোনো লেনাদেনা নেই। এরা বৃহত্তর কিংবা জাতীয় কোনো কল্যাণের প্রতি লক্ষ্যভেদী নয়। একদল বিনোদন, হাতাশা ও মৌজ-মাস্তিতে জীবন পার করছে, তো আরেকদল গভীর অভিনিবেশে ব্যক্তি-ক্যারিয়ার নিয়ে নিমজ্জিত হয়ে আছে। নতুন প্রজন্মের সেই তারুণ্যই তাদের প্রতি আরোপিত নেতিবাচকতার ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে ত্যাগ, সাহস ও বিজয়ের একটি দাস্তান হাজির করেছে। ২৪-এর জুলাই ও বর্ধিত জুলাইয়ের ঘটনাবহুল বাংলাদেশই তার দলীল।
। দুই।
তারুণ্য তো সব সময়ই সব পরিস্থিতিতেই উম্মাহর সম্পদ ও মনোযোগের কেন্দ্র। কারণ তারা আমাদের নতুন প্রজন্ম, আমাদের সন্তান ও উত্তরাধিকারী। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারবার তারুণ্যকে, যৌবনকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন, তারুণ্যের ইবাদত ও ইতিবাচকতাকে উৎসাহিত করেছেন। এর সঙ্গে যদি এসময়ের নতুন প্রজন্মকে এদেশের জুলাই-উত্তর তারুণ্যকে মিলিয়ে দেখা যায়- তাহলে একথা স্পষ্টতই অনুভবযোগ্য হয়ে ওঠে যে, নিবেদিত এই তারুণ্যের জন্য দ্বীন-ঈমানের ফিকির, তাদের প্রতি হিতাকাক্সক্ষা এবং যে কোনা শঙ্কা-বিপর্যয় থেকে তাদের উদ্ধার করার চেষ্টাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব জাতির প্রত্যেক শ্রেণির অভিভাবকের; বিশেষত যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখছেন, তাদের। আর বড় দায়িত্ব হচ্ছে তাদের, যারা উম্মাহর বিভিন্ন শ্রেণির মাঝে দাওয়াত ও ইসলাহের কাজ করছেন। দ্বীনী ও দুনিয়াবী উভয় দৃষ্টিতেই বর্তমান তারুণ্যের জীবনকে সাফল্য, শান্তি ও নেকী দিয়ে আচ্ছাদিত করে দেওয়ার চেষ্টা করা- আজকের তারুণ্যের একটি পাওনার মতো হয়ে গিয়েছে।
দেখুন, এত বড় একটি ত্যাগময় পরিস্থিতি ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর একটি নতুন পরিস্থিতিতে প্রবেশ করেছে দেশ। আবার প্রত্যেক তারুণ্যের জীবনেরও একেকটি নিজস্ব ভুবন আছে। সবকিছুর মধ্যে সঠিকতা ও সততা না চলতে থাকলে তাদের মনোজগতে অন্ধকার মেঘ ঘনিয়ে আসতে পারে। যেই মেঘ তাদের জীবনে হতাশা ও পথহীনতা তৈরি করে দিতে পারে। অপরদিকে দেশ ও জাতির নানামাত্রিক রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ও কৌশল প্রয়োজনে ব্যবহারে তাদের জীবন ব্যবহৃত উপাদানের মতো জীর্ণ হয়ে পড়তে পারে। শঙ্কাপূর্ণ পিচ্ছিল পথের তো অভাব নেই। তাদের সাহস, ভূমিকা ও ত্যাগের জন্য তাদের প্রতি অভিভাবকদের প্রতিদান ও পুরস্কার হতে পারে- তাদের যথাযথ পরিচর্যা, তাদের জীবনের সামনে গন্তব্য ও গন্তব্যমুখিতা নির্মাণ এবং সব রকম চোরাবালি থেকে রক্ষা করে সাফল্যের দিকে তাদের প্রতি অগ্রসরতার দিকনির্দেশনা।
কোনোভাবেই এ সময়ের সাহসী তারুণ্যকে নিকট ভবিষ্যতে হতাশাগ্রস্ততা কিংবা পথচ্যুতির দিকে ঠেলে দেওয়াটা অভিভাবকদের জন্য একদমই উচিত হবে না। এরকমটা ঘটতে পারে তারুণ্যের অন্তর্গত সৎ প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষার মধ্য দিয়ে, কিংবা অতিরিক্ত বাহবা এবং ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। এর কোনোটাই সঠিক না। দেশ, জাতি, সময় ও পরিস্থিতির জন্য যে বিশাল ত্যাগ ও সাহস তারা পেশ করেছে, তার বিনিময়ে তাদের জীবনকে গুছিয়ে দেওয়া, পরিপাটি ও গন্তব্যমুখী করে দেওয়াটাই বড়দের, অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সেই গুছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রটি হতে পারে যেমন দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে, তেমনি বৈধ ও কল্যাণকর দুনিয়াবী দৃষ্টিকোণ থেকেও।
। তিন।
সারাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও জেনারেল শিক্ষাধারার শিক্ষার্থী তরুণদের সুস্থ পার্থিব বা দুনিয়াবী সাফল্য কী হতে পারে জুলাই-২৪-এর পর, যেদিকে তাদের আহ্বান করা যায় এবং যে সাফল্যের গন্তব্যে পৌঁছাতে তাদের সহযোগিতা করা যায়? সহজ ও সংক্ষিপ্ত উত্তর হল, যথাযথ শিক্ষা অর্জন ও জীবন গঠন করার মধ্য দিয়ে সততাপূর্ণ সুস্থ একটি জীবন উপহার দেওয়া। শিক্ষা কারিকুলাম ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশে শুদ্ধি বা সুস্থতা এনে এটা করতে হবে। সুন্দর ও সততাপূর্ণ পেশাজীবনের প্রতি তাদের পৌঁছতে দিতে হবে। বিপথগামী কারিকুলাম, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও অসততাপূর্ণ পেশাজীবন, কিংবা অবৈধ উপার্জন-জীবন থেকে দূরে রাখার মতো ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
একটি রক্তস্নাত বৈপ্লবিক পর্ব অতিক্রম করার পর বাহ্যিক সাফল্য আসার পরও তরুণ প্রজন্মের জীবনে নানামাত্রিক অস্থিরতা, প্রত্যাশা ও স্বপ্নভঙ্গের উপলক্ষ্য তৈরি হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে। গত অর্ধ শতাব্দীর বিভিন্ন ঘটনার পর এটা দেখা গেছে। মূলত এই পরিস্থিতিটা তৈরি হয় বিভিন্ন বাস্তবতা ও মনোভঙ্গি থেকে। কেউ সৎ চেষ্টায় সৎভাবে সফল তারুণ্য যাপন করতে চেয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কষ্ট পায়। কেউ নিজস্ব ‘কৃতিত্ব’ ও ‘সাহসের’ পুরস্কার ও সুবিধা প্রত্যাশা করে ব্যথিত হয়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়। আবার কেউ বৈপ্লবিক বিজয়ের পর প্রাপ্ত নানান সুবিধা-বিলাসে পথচ্যুত হয়, বখে যায়। তাই তারুণ্যের গড়ে ওঠা ও রূপান্তরের এই গুরুত্বপূর্ণ মানসকালে তাদের জীবনকে সুপথে পরিচালিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকতে হয় অভিভাবকদের। সে অভিভাবকরা হবেন পরিবারের, শিক্ষাঙ্গনের ও রাষ্ট্রের। অভিভাবকরা তাদেরকে অস্থিরতা থেকে মুক্ত রাখবেন এবং ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে পরিশীলিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কষ্ট পেয়ে হতাশ হওয়া কিংবা সুবিধা-বিলাস পেয়ে বিচ্যুত হওয়া থেকে তারুণ্যকে রক্ষা করবেন; রক্ষা করার আন্তরিক ও দায়িত্বশীল প্রচেষ্টা জারি রাখবেন।
। চার।
একথা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার যে, তারুণ্যসহ সব বয়সী মানুষের হৃদয় ও জীবনের শুদ্ধির পথ হল তার দ্বীনী জীবনের অনুশীলন ও সৌন্দর্য। মুসলিমদের জন্য জীবনকে পরিশীলিত ও সুশোভিত করার উত্তম উপায় হচ্ছে ঈমান ও দ্বীনের সঙ্গে জীবনকে যুক্ত রাখা; দ্বীনী পরিচর্যায় জীবনকে সতেজ ও উজ্জীবিত রাখা। এজন্যই আমাদের প্রস্তাব থাকবে, জেনারেল ধারার শিক্ষার্থী তারুণ্যের সামনে ব্যাপকভাবে দ্বীন চর্চার ব্যবস্থাপনা উন্মুক্ত করে দেওয়া। দ্বীনের দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব চিন্তা ও আচরণ এবং পাপাচার থেকে মুক্ত থাকা দরকার, তারুণ্যকে সেইসব পাপাচারের দিকে ঠেলে না দেওয়া। গুনাহের কালিমা মানুষকে শেষ করে দেয়, গুনাহময় বিনোদন ও জীবনরীতি তারুণ্যকে হতাশাগ্রস্ত ও দুঃখী করে তোলে। জাতীয় পরিবেশ ও শিক্ষাঙ্গনের আবহ থেকে তাই গুনাহ ও অনৈতিকতার উপাদান-আয়োজন ও প্রোণোদনা দূরে সরিয়ে রাখা উচিত। আর একইসঙ্গে শিক্ষার্থী তারুণ্যের মধ্যে নেকীর চর্চা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। দরকার নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, অনানুষ্ঠানিক পদক্ষেপ কিংবা পরিবেশগত আনুকূল্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনে দ্বীনের সুস্থ ও সুখী বাতাস প্রবাহিত করা। নামায, তিলাওয়াত, সীরাত চর্চা, সদাচার, আখলাক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নবীজীর সুন্নতের অনুসরণ-অনুশীলনের মধ্য দিয়ে নেক জীবনে অনুপ্রাণিত হওয়ার দিগন্ত খুলে দেওয়া। দ্বীনের সঙ্গে তারুণ্যের এই সহযাত্রা কিংবা দ্বীনের অনুশীলনের সঙ্গে, নেকীর সঙ্গে তারুণ্যের এই সুন্দর সখ্য তারুণ্যকে প্রকৃত অর্থেই সফল পথচলা ও প্রকৃত গন্তব্যের সন্ধান দিতে পারে।
আজকের এই তরুণেরা, আমাদের এই সন্তানেরা অজেয় সাহস ও রক্তস্নাত আত্মত্যাগ দিয়ে জুলুম ও বিদ্বেষের এক জগদ্দল পাথরকে সরিয়ে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাদের জীবন, শিক্ষা, মনন, আখলাক ও দ্বীন-ঈমানের সঠিক পরিচর্যায় পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করা উচিত। অস্থিরতার পর দ্বীন অনুশীলন ও গন্তব্যমুখী পথচলাই হচ্ছে তাদের জীবনের সর্বোত্তম মোটিভেশন, তাদের দুনিয়া-আখেরাতের সর্বোচ্চ সাফল্য। আল্লাহ তাআলা এই নতুন প্রজন্মকে দ্বীন ও কল্যাণের জন্য কবুল করুন।